Translate

Thursday, May 22, 2025

From a Insider

 বাঙলার ইতিহাস বেশ পুরনো। ইতিহাসে আমরা যে বাংলাকে পাই, সেই বাংলার ইতিহাস হাজার বছরের। বাংলা শাসন করেছে মগ, ফিরিঙ্গি, সেন, মুঘল, ইংরেজ, পাকিস্তানি ও বাঙালি নিজে। বাঙালির সমালোচনার শেষ নেই।একদিকে বাঙালির সমালোচনা করেছেন বিদেশি শাসক,গবেষক,সাহিত্যিক ও পর্যবেক্ষক।অন্যদিকে অনেক বাঙালিও বাঙালি আর বাংলাকে নিয়ে সমালোচনার ঝড় তুলেছেন।


বাঙালি অভিহিত হয়েছে ‘আত্মবিস্মৃত’, ‘আত্মভ্রষ্ট’, ‘আত্মঘাতী’ বলে। বাঙালিকে অনেকেই বলেছেন আত্মকেন্দ্রিক, সমাজবিমুখ, উগ্র,অসহিষ্ণু, নেতিপ্রবণ (কেবল প্রতিবাদ–প্রতিরোধে আগ্রহী, গঠনমূলক চিন্তায় অনীহ), তর্কপ্রবণ, রঙ্গপ্রিয়, ভোগলিপ্সু,

কর্মকুণ্ঠ, অলস, ভীরু, ভাবালু। বাঙালি মস্তিষ্কের উর্বরতা ও অপব্যবহার সম্পর্কেও বলা হয়েছে অনেক কথা।বাঙালি সম্পর্কে এসব কথা বলা হয়েছে বিশেষ বিশেষ ব্যর্থতার পটভূমিতে আবহমান কালের ইতিহাসকে সামনে নিয়ে। কিন্তু ইতিহাসের সব পর্যায়ে বাঙালি চরিত্রকে এক রকম দেখা যায় না। কোনো জাতির জাতীয় চরিত্রই ইতিহাসের সব পর্যায়ে এক রকম থাকে না। প্রতিটি ঐতিহাসিক কালেরই স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য থাকে। কোনো কোনো ঐতিহাসিককালে কোনো কোনো ক্ষেত্রে বাঙালি উন্নত মানসিকতার ও অসাধারণ সৃষ্টিশক্তিরও পরিচয় দিয়েছে। বাঙালি চরিত্রে অনেক প্রশংসনীয় বৈশিষ্ট্যও আছে।


উপমহাদেশে ব্রিটিশ রাজত্ব করেছে দুশো বছর। ব্রিটিশরা বাঙালিকে মোটেও পাত্তা দেয় নি।বাঙালি সম্পর্কে ব্রিটিশ শাসকদের এমনও মনতব্য শোনা যায়, বাঙালি চরিত্রের অন্যতম বৈশিষ্ট হল মিথ্যা বলা।’ 


হুমায়ুন আজাদ, যিনি একই সাথে জনপ্রিয় এবং অত্যাধিক সমালোচিত একজন লেখক, কিন্তু একজন মনস্তাত্ত্বিক মতো করে বাঙালির বাঙালিপনার চুল-চেরা বিশ্লেষণ করেছেন। তিনি গভীর মনোযোগের সাথে বাঙালির চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যাবলী পর্যবেক্ষণ করে বলেছেন: জাতি হিসেবে বাঙালি বাচাল ও বাকসর্বস্ব; অপ্রয়োজনেও প্রচুর কথা বলে। বাঙালির স্বভাব উঁচু গলায় কথা বলা; সাধারণত শুরুই করে উচ্চকণ্ঠ, বা ক্রমশ তার গলার আওয়াজ চড়তে থাকে। যদি আলাপের বিষয় বিতর্কিত হয় পক্ষবিপক্ষ থাকে, তাহলে অল্প সময়েই তারা প্রচণ্ড আওয়াজ সৃষ্টি করতে থাকে; এবং অংশগ্রহণকারীর সংখ্যা যদি দুয়ের বেশি হয়, তিন-চার-পাঁচজন হয়, তাহলে আলোচনা পুরোপুরি পণ্ড হওয়ার সম্ভবনা থাকে। যে-কোনো আলাপে বাঙালি নিজেই নিজেকে প্রবেশ করিয়ে দেয়, অন্যদের অনুমতির প্রয়োজন বোধ করে না; এমনকি, অনেক সময়, আলোচ্য বিষয় সম্পর্কে কিছু না জেনেই বাঙালি তীব্র আলোচনায় অংশ নেয়। বাঙালির যুক্তি কণ্ঠের উচ্চতা; যার কণ্ঠ যতো উঁচু, সে নিজেকে ততোটা যুক্তিপরায়ণ ব’লে গণ্য করে; এবং নিজের জয় অবধারিত ব’লে জানে। যুক্তিতে কোনো বাঙালি কখনো পরাজিত হয় নি, হয় না, ভবিষ্যতেও হবে না। বাঙালি কথায় সাধারণত ভুল শব্দ ব্যবহার করে, বাক্য সম্পূর্ণ করে না; এক কথা ব’লে অন্য কথা বুঝিয়ে থাকে। বাঙালি উচ্চকণ্ঠে আলাপ করে, অযুক্তি পেশ করে, এবং অনেকের মাঝখানে থেকেও ফিসফিশে স্বরে চমৎকার চক্রান্ত করতে পারে। বাঙালি কারো সাথেই দেখা হ’লেই কথা বলে, কথার কোনো প্রয়োজন না থাকলেও। বাঙালি প্রচুর মিথ্যে কথা ব’লে থাকে, অনেকে মিথ্য বলাকে মনে করে চাতুর্য, একধরনের উৎকর্ষ। বাঙালির প্রতিটি এলাকায় অন্তত একজন পেশাদার মিথ্যেবাদী পাওয়া যায়। দক্ষিণ ভারতে একটি উপজাতি রয়েছে, যারা চল্লিশ বছর বয়স্ক হওয়ার পর কথা বলাই থামিয়ে দেয়; তাদের কথা বলার মতো আর কিছু থাকে না। বাঙালি এর বিপরীত-বয়স বাড়ার সাথে কথাও বাড়তে থাকে বাঙালির; বাঙালি বুড়োরা কথা বলার জন্যে প্রসিদ্ধ।


তিনি স্পষ্টভাবে দেখিয়েছেন বাঙালির অভদ্রতা জ্ঞান, সুবিধা আদায়ের কর্মপ্রণালী, অচেনা কোনো আগন্তুক এলে কীভাবে নেতিবাচক মনোভাব নিয়ে তার প্রতি যেন করুণা করতে চায়। অযথা নানা কাজে ব্যস্ততার ভান করে, নানা দিকে কর্মব্যস্ত হয়ে উঠে। নানা বাহানা করে, ছল করে, এ যেন অন্যকে ছোট করে, নিজে বড় হবার প্রাণপণ চেষ্টা।তিনি বাঙালিকে যেভাবে আবিষকার করেছেন, তার নিখুঁত বর্ণনা তিনি এভাবে দিয়েছেন: বাঙালি স্বভাবত ভদ্র নয়। সুবিধা আদায়ের সময় বাঙালি অনুনয়-বিনয়ের শেষ সীমায় যেতে পারে, কিন্তু সাধারণত অন্যদের সাথে ভদ্র আচরণ করে না। বাঙালি প্রতিটি অচেনা মানুষকে মনে করে নিজের থেকে ছোটো, আগন্তুক মাত্রকেই মনে করে ভিখিরি। কেউ এলে বাঙালি প্রশ্ন করে, কী চাই?’ অপেক্ষা করার জন্যে বলে, দাঁড়ান’। কোনো কর্মস্থলে গেলে বাঙালির অভদ্রতার পরিচয় চমৎকারভাবে পাওয়া যায়। যিনি কোনো আসনে ব’সে আছেন কোনো কর্মস্থলে, তাঁর কাছে কোনো অচেনা মানুষ গেলে তিনি সুব্যবহার পাবেন না, এটা বাঙালি সমাজে নিশ্চয়ই। অসীম কর্মকর্তা, তিনি যতো নিম্নস্তরেই থাকুন-না-কোনো, তিনি আগন্তকের দিকে মুখ তুলেও তাকাবেন না; তাকালে মুখটি দেখে নিয়েই নানা অকাজে মন দেবেন। তিনি হয়তো পান খাবেন, অপ্রয়োজনে টেলিফোন করবেন, পাশের টেবিলে কাউকে ডেকে বাজে কথা বলবেন, আগনু্তকের দিকে মনোযোগ দেবেন না। সামনে কোনো আসন থাকলেও আগনু্তককে বসতে বলবেন না। বাঙালি অন্যকে অপমান ক’রে নিজেকে সমমানিত করে।’ (হুমায়ুন আজাদ নির্বাচিত প্রবন্ধ পৃষ্ঠা ২৫৫-২৫৬) হয়তো কেউ কেউ তাঁর এ ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের সাথে একমত নাও হতে পারেন। কিন্তু তিনি যা বলেছেন, বাঙালি চরিত্র বিশ্লেষণ করেই তিনি এ ধরনের সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন। এ সব বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে গেলে আরও গবেষণার দরকার পড়তে পারে। তবু এ সব কিছুর মধ্য দিয়ে বাঙালির প্রাথমিক পরিচয় কিছুটা হলেও পাওয়া যাবে।


বাঙালি খুব পরনিন্দা প্রিয়, পরনিন্দায় বাঙালি আত্মতৃপ্তি পায়। আবার শক্তিমানকে পুজা দেয়, সমমান করে, ভক্তি-শ্রদ্ধা করে।

বাঙালির সৌন্দর্যজ্ঞান কী লেখক তার ব্যাখ্যা হাজির করেছেন নাটকীয়ভাবে। বাঙালি ফরশাকে সাহেব এবং লম্বাকে পাঠানের সাথে কিভাবে তুলনা করে তা তিনি সুন্দরভাবে তুলে ধরেছেন। হুমায়ুন আজাদ সমালোচকের চোখে তার একটা ব্যাখ্যাও হাজির করে বলেছেন: বাঙালি দরিদ্র কিন্তু অপচয়প্রবণ; আর বাঙালি সময়ের মূল্যবোধহীন। দারিদ্রের একটি বৈশিষ্ট্য সম্ভবত অপচয়, বা অপচয়ে তারা গৌরব বোধ করে। গরিব বাঙালির বাড়িতে গেলেও নানা অপচয় চোখে পড়ে। ভাতের অভাব বাঙালির জীবনে ঐতিহাসিক সত্য ও নিয়তি; কিন্তু প্রতি বাড়িতেই প্রতিদিন কিছু পরিমাণ হ’লেও ভাতের অপচয় ঘটে। কেউ হয়তো খাওয়ার সময় কিছু ভাত ফেলে দেয়, কেউ না-খেয়েই উঠে যায়; কিন্তু ধনী দেশগুলোতে এক টুকরো রুটিরও অপচয় হয় না। রাষ্ট্রীয়ভাবে বাঙালির অপচয়ের কোনো শেষ নেই, এটা ব্যক্তির অপচয়েরই রাষ্ট্রীয় পরিণতি। বাঙালির রাষ্ট্রযন্ত্র প্রতিদিন অপচয় ক’রে চলে, কিন্তু জাপানে একটি ইয়েনেরও অপচয় ঘটে না। অপব্যয় বাঙালির স্বভাব ও সামাজিক দাবি।’তাঁর সংজ্ঞায় বাঙালির জীবনই হল অপচয়ের যন্ত্র। তিনি গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করে বলেছেন, বাঙালি গাল-গল্প থেকে শুরু করে কাপড় তৈরিতে পর্যন্ত প্রচুর সময় অকারণে নষ্ট করে। বাঙালি কাউকে সময় দিলে কথা ঠিক রাখে না, সাধারণত কাউকে সময় দিলে দু-এক ঘণ্টার হের-ফের করাকে স্বাভাবিক ভাবে।


তাঁর মতে, বাঙালি সুবিধাবাদী; সুবিধার জন্যে বাঙালি সব কিছু করতে পারে। তিনি মনে করেন, বাঙালি জানে না, কাকে শ্রদ্ধা করতে হয়, আর কাকে ঘৃণা করতে হয়। তিনি আরও মনে করেন, বাঙালি কোনো ব্যাপারে ভুল সিদ্ধান্ত নিলে আর তা ত্যাগ করতে পারে না, ভুলকেই ঠিক মনে করে।তিনি সমাধানও দিয়ে দিয়েছেন। এ কাজ করতে পারবে মনোবিজ্ঞানী ও সমাজবিজ্ঞানী। এ ধরনের রুগ্ন সমাজকে চিকিৎসা দিতে হলে, পচন রোধ করতে গেলে এখন সুচিকিৎসার প্রয়োজন বলে তিনি মনে করেন। তিনি কার কাছে গেলে রুগ্ন বাঙালি সুস্থ হয়ে উঠবে, তাও বলে দিয়েছেন। আমরা আবার লেখকের কাছে ফিরে যাই, কারণ তিনি কেবল আমাদের আশাহতই করে নি, আশার আলোও জ্বেলে দেখিয়েছেন। আমরা তাঁর মুখেই সেই বিষয়টি জানি--’মনোবিজ্ঞানীর চোখ দেয়া দরকার এদিকে, যেমন চোখ দেয়া দরকার সমাজবিজ্ঞানীর। বাঙালির রুগ্নতা আর লুকিয়ে রাখা চলে না, ক্ষতস্থলকে ময়লা কাপড়ে মুড়ে রাখলে ক্ষত শুকোয় না তাতে পচন ধরে। পচন ধরেছে এর মাঝেই। বাঙালির চিকিৎসার কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না; একটি জনগোষ্ঠি কি রুগ্ন থেকে রুগ্নতর হ’তে হ’তে লুপ্ত হয়ে যাবে?’ (হুমায়ুন আজাদ নির্বাচিত প্রবন্ধ পৃষ্ঠা ২৫৬)।


বাঙালি চরিত্রের জটিলতা মনস্তত্ত্ব নিয়ে রবীন্দ্রনাথের নিজের ব্যাখ্যা ছিল এ ধরনের, তিনি ব্যাখ্যা করে দেখিয়েছেন--আমরা আরম্ভ করি শেষ করি না; আড়ম্বর করি,কাজ করি না; যাহা অনুষ্ঠান করি তাহা বিশ্বাস করি না; যাহা বিশ্বাস করি তাহা পালন করি না; ভূরিপরিমাণ বাক্যরচনা করিতে পারি, তিলপরিমাণ আত্মত্যাগ করিতে পারি না; আমরা অহংকার দেখাইয়া পরিতৃপ্ত থাকি, যোগ্যতালাভের চেষ্টা করি না; আমরা সকল কাজেই পরের প্রত্যাশা করি, অথচ পরের ত্রুটি লইয়া আকাশ বিদীর্ণ করিতে থাকি; পরের অনুকরণে আমাদের গর্ব, পরের অনুগ্রহে আমাদের সমমান, পরের চক্ষে ধুলিনিক্ষেপ করিয়া আমাদের পলিটিক্‌স; এবং নিজের বাক্‌চাতুর্যে নিজের প্রতি ভক্তিবহুল হইয়া উঠাই আমাদের জীবনের প্রধান উদ্দেশ্য। - চারিত্রপূজা। (বিদ্যাসাগর-চরিত, রবীন্দ্রগদ্যের উদ্ধৃতি সংগ্রহ ১৯৪)


উপরোক্ত প্রবন্ধে বাংলার দিকপাল মণিষীরা বাঙালির যে সমালোচনা করেছেন তাকে বাঙালির প্রতি তাঁদের বিদ্বেষ বা ঘৃণা মনে করা সমচীন নয়। বাঙালির প্রতি তাঁদের সমালোচনা বরং বাঙালির প্রতি তাঁদের গভীর ভালোবাসারই বহিঃপ্রকাশ।






No comments:

Post a Comment