Translate

Sunday, May 10, 2020

জীবনের হাজারো বাঁক!


২০০৪ সালের ১৪ ই অগস্ট, ধনঞ্জয়ের ফাঁসি হয়েছিল। সেদিনই ছিল ধনঞ্জয়ের জন্মদিন। এই বছর বারো পরে এসে দেখা যাচ্ছে সেই ফাঁসির আদেশের পিছনে যে তদন্ত এবং বিচার-প্রক্রিয়া নিয়ে বিতর্কের শেষ নেই।
(ছবিঃ- ধনঞ্জয় চট্টোপাধ্যায়)
মানুষ মাত্রেই ভুল হয়৷ বিচারক, বিচারপতিরাও মানুষ৷ ভুল সিদ্ধান্তে পৌঁছনো তাঁদের পক্ষেও অসম্ভব নয়৷ তেমন সিদ্ধান্তের বাস্তবায়ন যদি হয় চরিত্রগত ভাবেই ‘অপরিবর্তনীয়’, ন্যায়বিচারের ধারণা কি ধূলিসাত্‍ হয় না? ধনঞ্জয়ের বহুচর্চিত মৃত্যুদণ্ডের পুনর্বিশ্লেষণ উস্কে দিচ্ছে এমন মৌলিক প্রশ্নই৷
ঘটনার বিবরণ-
১৯৯০ সালের ৫ মার্চ কলকাতার পদ্মপুকুর এলাকার আনন্দ অ্যাপার্টমেন্টের চারতলার ফ্ল্যাটে ১৮ বছর বয়সের আইসিএসই পরীক্ষার্থিনী হেতাল পারেখ খুন হন। বাঁকুড়ার কুলুডিহি গ্রাম থেকে কলকাতায় কাজ করতে আসা ধনঞ্জয় চট্টোপাধ্যায় সেই অ্যাপার্টমেন্টের নিরাপত্তারক্ষী ছিলেন। অভিযোগ ওঠে, ধর্ষণ করে খুন করা হয়েছে ওই কিশোরীকে। এই ঘটনার জন্য দোষী সাব্যস্ত হন। সুদীর্ঘ ১৪ বছরের বিচারপর্বে তাঁকে নিয়ে কম বিতর্ক হয়নি। ধনঞ্জয়রের মৃত্যুলগ্নে তাঁর স্ত্রী গণমাধ্যমের কাছে দাবী করেছিলেন– “১৪ বছর জেল এক অর্থে যাবজ্জীবন। তাহলে এতদিন পর ফাঁসি কেন”? কিন্তু, শেষ অবধি ধনঞ্জয়রের ফাঁসিই হয়েছিল।
ধনঞ্জয় সম্ভবত প্রথমবার খবরের কাগজে নাম তোলে পরেরদিন, খুনের খবরের সঙ্গে। ৬ তারিখ কলকাতার সমস্ত প্রথম সারির দৈনিক হইহই করে ছাপে হেতালের নৃশংস খুনের খবর। সঙ্গে উঠে আসে ধনঞ্জয়ের নামও। সংবাদপত্রের প্রতিবেদনে জানানো হয়,
“ভবানীপুর থানার পদ্মপুকুর রোডে আনন্দ অ্যাপার্টমেন্টের একটি ফ্ল্যাটে সোমবার সন্ধ্যা সাড়ে পাঁচটা নাগাদ হেতাল পারেখ নামে ১৮ বছরের এক তরুণীকে খুন করা হয়। গলায় রুমাল বেঁধে ফাঁস দিয়ে এবং মাথায় ভারি কোনো জিনিস দিয়ে ওঁকে খুন করা হয়েছে বলে পুলিশের ধারণা। ওঁর হাত পায়ের হাড়ও ভেঙেছে বলে ডাক্তাররা অনুমান করছেন। পরনে ছেঁড়া সায়া, ব্লাউজ। পুলিশের অনুমান, খুন করার আগেই ওঁকে ধর্ষণ করা হয়েছে। ঘরের আলমারির দরজা ছিল খোলা। তবে কিছু খোওয়া গেছে কিনা এখনও জানা যায়নি। ঘটনার পরেই ওই অ্যাপার্টমেন্টের সিকিউরিটি গার্ড ধনঞ্জয় চ্যাটার্জি (২৬) উধাও হয়েছে। পুলিশ এখন তাকে খুঁজছে।
ধনঞ্জয়কে পুলিশ কেন খুঁজছে, তা নিয়েও আলোকপাত করে সংবাদপত্রের প্রতিবেদন। “ওই অ্যাপার্টমেন্টের লিফটম্যান রামধনী। পুলিশকে ও জানায় যশোমতী (হেতালের মা – বর্তমান লেখক) মন্দির থেকে ফিরে আসার মাত্র মাত্র পাঁচ মিনিট আগে ওই বাড়িরই সিকিউরিটি গার্ড ধনঞ্জয় চ্যাটার্জিকে ও দেখেছে লিফট করে উপর থেকে নিচে নামতে। ধনঞ্জয়ের পরনে ছিল সাদা জামাপ্যান্ট। তবে তাতে রক্তের কোনো দাগ ছিলনা বলেই তার মনে হয়েছে। সঙ্গে সঙ্গেই খোঁজ পড়ে ধনঞ্জয়ের। ওই বাড়িতেই রয়েছে কোয়ার্টার। ওখানে ওকে পাওয়া যায়না। ওর বাড়ি কাছাকাছি মহেন্দ্র রোডে। ওখানেও নেই। সম্ভাব্য আরও কিছু জায়গায় খোঁজা হল। কিন্তু কোথাও কোনো হদিশ পাওয়া গেলনা।” (আজকাল এর প্রতিবেদন, ৬ ই মার্চ ১৯৯০)
এখানে মনে রাখা দরকার, খুনের খবর পুলিশ পায় রাতে। পুলিশের সাব-ইন্স্পেক্টর গুরুপদ সোম, হেতালের বাবা নাগরদাস পারেখের কাছ থেকে খুব অগোছালো টেলিফোন বার্তা পেয়ে ঘটনাটি সম্পর্কে অবহিত হন। তাঁর আদালতে দেওয়া বয়ান অনুযায়ী টেলিফোনটি তিনি পান রাত ৯-১৫ নাগাদ। বার্তাটি ছিল ছোট্টো, শুধু খুনের খবরটিই দেওয়া হয়। এর পরে ঘটনাস্থলে পুলিশ পৌঁছয়, আদালতের বয়ান অনুযায়ী জিজ্ঞাসাবাদ চলে গভীর রাত পর্যন্ত। সংবাদপত্রের বিবরণ অনুযায়ী এরই সঙ্গে চলে ধনঞ্জয়কে সমস্ত সম্ভাব্য জায়গায় খুঁজে পাওয়ার চেষ্টা। প্রভাতী সংবাদপত্রে প্রকাশ করার জন্য প্রতিবেদন যদি রাত ২ টো তেও লেখা শুরু হয়েছে বলে ধরে নেওয়া হয়, তবে, খুনের এই সম্ভাব্য আখ্যানটি আসলে পরেরদিন নয়, তৈরি হয়ে যায় পুলিশ আসার অন্তত কয়েকঘন্টার মধ্যে।
ধনঞ্জয়কে খুন করতে কেউ দেখেনি। রক্তাক্ত অবস্থায় পালাতেও না। কিন্তু মাত্র কয়েকঘন্টার মধ্যেই খুনের আখ্যানে জড়িয়ে যায় ধনঞ্জয়ের নাম। সম্ভাব্য অপরাধী বা ভিলেন হিসেবে।
সংবাদপত্রের প্রতিবেদন অনুযায়ী কলকাতা পুলিশের তৎকালীন ডিসিডিডি প্রসূন মুখার্জি সেদিন গভীর রাতে ফ্ল্যাটে বসেই এই হত্যার কাহিনী সাংবাদিকদের শোনান। (বর্তমান পত্রিকা ৬ ই মার্চ ১৯৯০)। ফলে এই প্রতিবেদনগুলির সঙ্গে “অফিশিয়াল” পুলিশি বিবৃতির একটা সম্পর্ক আছে। এমনকি খবরের কাগজের প্রতিবেদন ধনঞ্জয়কে এই আখ্যানে কেন জড়িয়ে ফেলা হল, তারও কিছু ব্যাখ্যা পাওয়া যায়। একটি কাগজ লেখে
“মেয়েটির মা বেরিয়ে যাবার পরই (অর্থাৎ খুনের ঘটনার সম্ভাব্য সময় – বর্তমান লেখক) ওই বাড়ির সিকিউরিটি গার্ড জনৈক ধনঞ্জয় চ্যাটার্জি ফোন করার অছিলায় ওই ফ্ল্যাটে ঢুকেছিল বলে অভিযোগ শোনা গেছে। এই ঘটনার পর তাকে খুঁজে পাওয়া যায়নি। পুলিশ অবশ্য এ ব্যাপারে মুখ খুলতে রাজি নয়।” (বর্তমান পত্রিকা ৬ ই মার্চ ১৯৯০)
ডিটেলিং এর প্রশ্নে অবশ্যই অনেক পরে আদালতে পেশ করা আখ্যানটি অনেক সুবিন্যস্ত। খবরের কাগজের খাপছাড়া ভাবটা একেবারেই নেই। ভূমিকা, উপসংহার সহ আখ্যান সেখানে একেবারেই স্বয়ংসম্পূর্ণ। বস্তুত “স্বীকৃত” আখ্যানে কাহিনী মোটেই খুনের দিন শুরু হচ্ছেনা। হচ্ছে তার তিনদিন আগে। অর্থাৎ মার্চের ২ তারিখ। সেখানে ঘটনা শুরু হচ্ছে ধনঞ্জয়ের বিরুদ্ধে হেতালের অভিযোগ দিয়ে। ধনঞ্জয় চট্টোপাধ্যায়ের আপিল মামলায় হাইকোর্টের রায়ের অংশবিশেষ থেকে পড়লে সেই “আদালত-স্বীকৃত” কাহিনীটি মোটামুটি এরকমঃ
মার্চের দুই তারিখে অর্থাৎ খুনের তিনদিন আগে, হেতাল তার মা যশোমতী পারেখের কাছে অভিযোগ করে, যে, ধনঞ্জয় স্কুলে যাতায়াতের পথে তাকে বিরক্ত (টিজ) করে, এবং সেদিন ধনঞ্জয় তাকে একসঙ্গে সিনেমা দেখতে যাবার প্রস্তাব দিয়েছে। যশোমতী তাঁর স্বামী নগরদাস পারেখকে ঘটনাটি জানান। নগরদাস যে সিকিউরিটি এজেন্সি থেকে ধনঞ্জয়কে নেওয়া হয়েছিল, সেখানে ধনঞ্জয়ের নামে অভিযোগ করেন, এবং ধনঞ্জয়ের জায়গায় অন্য কোনো নিরাপত্তারক্ষীকে নিয়োগ করতে বলেন। দুদিন পর, অর্থাৎ মার্চের চার তারিখে সিকিউরিটি এজেন্সি ধনঞ্জয়কে একটি লিখিত ট্রান্সফার অর্ডার দেয়। ধনঞ্জয়কে আনন্দ অ্যাপার্টমেন্ট থেকে সরিয়ে পরশ অ্যাপার্টমেন্ট নামক অন্য একটি বহুতলে ডিউটি দেওয়া হয়। বদলি হিসেবে পরশ অ্যাপার্টমেন্টের তৎকালীন নিরাপত্তারক্ষী বিজয় থাপাকে সরিয়ে আনা হয় আনন্দ অ্যাপার্টমেন্টে। এই ব্যবস্থাটি চালু হবার কথা ছিল পরের দিন, মার্চের পাঁচ তারিখ, অর্থাৎ খুনের দিন থেকে।
খুনের দিন, অর্থাৎ পাঁচ তারিখ, হেতালের বাবা নগরদাস সকাল ৯ টায় ব্যবসার কাজে বেরিয়ে যান। হেতালের দাদা ভবেশ(হেতালের থেকে এক বছরের বড়ো) কলেজ থেকে বাড়ি ফেরে সাড়ে এগারোটায়, তারপর খাওয়া দাওয়া করে বাবাকে ব্যবসায় সাহায্য করতে বেরিয়ে যায়। আইসিএসই পরীক্ষার্থিনী হেতাল পরীক্ষা দিয়ে বাড়ি ফেরে দুপুর ১টা নাগাদ। যশোমতীর অভ্যাস প্রতিদিন বিকেলে স্থানীয় লক্ষ্মীনারায়ণ মন্দিরে যাওয়া। তিনি সেদিন বেরোন ৫-২০ নাগাদ। বাড়িতে হেতাল থাকে একা।
সেদিনই বদলি হয়ে যাবার কথা থাকলেও ধনঞ্জয় সেদিন আনন্দ অ্যাপার্টমেন্টেই সকাল ৬টা থেকে দুপুর ২টো পর্যন্ত ডিউটি দেয়, প্রতিদিনের মতই। যশোমতী বেরিয়ে যাবার কিছুক্ষণ পরে ধনঞ্জয় পরের শিফটের নিরাপত্তারক্ষী দশরথ মুর্মুর কাছে এসে বলে সে সিকিউরিটি এজেন্সির অফিসে (যেখানে ধনঞ্জয় এবং দশরথ দুজনই কর্মরত) টেলিফোন করার জন্য হেতালদের ফ্ল্যাটে যাচ্ছে। এবং তারপর সে লিফট ধরে উপরে উঠে যায়। আরও সামান্য সময় পরে, ৫-৪৫ নাগাদ সিকিউরিটি এজেন্সির সুপারভাইজার প্রতাপচন্দ্র পতি আসেন ওই ফ্ল্যাটবাড়িতে। বিজয় থাপা আসেনি এবং ধনঞ্জয় প্রতিদিনের মতই কাজ করেছে শুনে তিনি ধনঞ্জয়ের খোঁজ করেন। প্রথমে ইন্টারকমে হেতালের ফ্ল্যাটে ফোন করা হয়। কেউ না ধরায় ওই ডিউটির জায়গা থেকেই দশরথ মুর্মু চিৎকার করে ধনঞ্জয়ের নাম ধরে ডাকেন। ধনঞ্জয় চারতলায় হেতালের ফ্ল্যাটের ব্যালকনি থেকে ঝুঁকে পড়ে উত্তর দেয়, যে সে নিচে আসছে। নিচে নামার পর ধনঞ্জয়ের কাছে জানতে চাওয়া হয়, সে পরশ অ্যাপার্টমেন্টে কাজে যায়নি কেন। সে বলে, তার কিছু ব্যক্তিগত সমস্যা ছিল। তারপর সে আনন্দ অ্যাপার্টমেন্ট থেকে বেরিয়ে যায়, এবং পুলিশের হাতে নিজের গ্রামে প্রেপ্তার হওয়ার আগে পর্যন্ত তার আর কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি।
যশোমতী অভ্যাস মতো মন্দির থেকে ফেরেন ৬-০৫ নাগাদ। লিফটে ওঠার সময় লিফটম্যান রামধনি তাঁকে বলেন, ধনঞ্জয় সিকিউরিটি এজেন্সিকে টেলিফোন করার জন্য তাঁদের ফ্ল্যাটে গিয়েছিল। শুনে যশোমতী বিচলিত হয়ে পড়েন। উপরে উঠে তিনি দরজায় বেশ কয়েকবার বেল বাজান। কোনো শব্দ না পাওয়ায় তিনি চিৎকার চেঁচামেচি শুরু করেন। চারদিকে লোকজন জমে যায় (মূলত নানা ফ্ল্যাটের ভৃত্যকুল)। তারা সবাই মিলে দরজা ভাঙে। ফ্ল্যাটের একটি বেডরুমে হেতালের অচৈতন্য দেহ পাওয়া যায়। পোশাক আশাক এলোমেলো এবং খোলা ছিল, শরীর ছিল রক্তাক্ত। যশোমতী অচৈতন্য মেয়েকে কোলে তুলে লিফটে করে নিচে নামেন। পড়শিরা একজন্ ডাক্তার ডাকেন, তিনি দেখে হেতালকে মৃত ঘোষণা করেন। হেতালের দাদা ভবেশ ফিরে আসে ৭টা নাগাদ। ইতিমধ্যে আরও একজন ডাক্তার আসেন, তিনিও হেতালকে মৃত ঘোষণা করেন। হেতালের দেহ উপরে তার নিজের ফ্ল্যাটে তোলা হয়। পুলিশকে তখনও কোনো খবর দেওয়া হয়নি।
হেতালের মৃতদেহ ওভাবেই তার খাটে পড়ে থাকে ঘন্টা দেড়েক। যশোমতীর স্বামী নগরদাস বাড়ি ফেরেন সাড়ে ৮টায়। তারও ৪৫ মিনিট পরে তিনি ভবানীপুর থানায় ফোন করেন। খবর পেয়ে সাব-ইনস্পেক্টর গুরুপদ সোম আরও কয়েকজনের সঙ্গে ফ্ল্যাটে আসেন। যাশোমতী পারেখের জবানবন্দী রেকর্ড করা হয়। এবং সেটাকেই প্রথম এফআইআর হিসেবে গ্রহণ করে তদন্ত শুরু হয়। ( এই পর্যন্ত ধনঞ্জয় চট্টোপাধ্যায়ের আপিল মামলায় হাইকোর্টের রায়ের অংশবিশেষ থেকে সংক্ষেপিত)।
পুলিশের দাবি ছিল, অ্যাপার্টমেন্টের লিফটম্যান খুনের আগে ধনঞ্জয়কে তিন তলায় পৌঁছে দিয়েছিলেন৷ আদালতে কিন্তু সেই লিফটম্যানই জানান, তেমন কিছুই তিনি করেননি৷ জানেন না৷ এমন গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষীকে ‘বিগড়ে যাওয়া’ (হোস্টাইল) ঘোষণা করতে বাধ্য হয় সরকারপক্ষ৷ তিনি ডাকায় তিন তলার ফ্ল্যাটের বারান্দা থেকে ঝুঁকে ধনঞ্জয় জবাব দিয়েছিলেন, অন্য এক নিরাপত্তারক্ষীর এমন দাবিও হালে পানি পায় না ওই বাড়ির বিল্ডিং প্ল্যানের দিকে নজর ফেরালেই৷ কারণ বারন্দাটাই যে আগাগোড়া গ্রিল দিয়ে ঘেরা! রক্তে ভেসে যাচ্ছিল হেতালের দেহ, অথচ কোনও সাক্ষীই ধনঞ্জয়ের পোশাকে দাগ দেখেছেন, এমন দাবি করতে পারেননি৷ পারেখ পরিবারের দাবি মতো খোওয়া যাওয়া হাতঘড়ির বিলের সঙ্গে ধনঞ্জয়ের বাড়ি থেকে উদ্ধার হওয়া ঘড়ির নম্বর মিলিয়ে পর্যন্ত দেখা হয়নি৷ অকুস্থলে উদ্ধার হওয়া গলার হার ধনঞ্জয়ের বলে দাবি করা হলেও অ্যাপার্টমেন্টেরই এক পরিচারক দাবি করেন, সেটি তাঁর৷ সর্বোপরি হেতালের গোপনাঙ্গে শুক্রাণুর নমুনা মিললেও তা ধনঞ্জয়েরই কি না, ডিএনএ পরীক্ষায় মিলিয়ে দেখা হয়নি৷
পুলিশের দাবি মতো ধনঞ্জয়ের বাড়ি থেকে উদ্ধার হওয়া প্যান্ট-শার্ট, হাতঘড়ির সিজার লিস্টে নিরপেক্ষ কোনও সাক্ষীর সই ছিল না৷ থানায় চা-সরবরাহকারী আর এক দোকানদার ছাড়া আর কাউকেই নাকি পায়নি পুলিশ! সেই দোকানদার আবার আদালতে সাক্ষ্য দিতেও আসেননি৷ হেতালকে ধনঞ্জয় উত্ত্যক্ত করতেন, পারেখ পরিবারের দাবির সমর্থনে নিরাপত্তা কর্মী নিয়োগের এজেন্সিকে লেখা ওই কিশোরীর বাবার চিঠির ভাষা ও শব্দবিন্যাসে ঘটনার পরে সাবুদ তৈরি করতেই তা লেখানো কি না, উঠেছে তেমন প্রশ্নও৷ পুলিশের দাবি, ৫ মার্চ বিকেল ৫টা ২০ থেকে ৫টা ৫০-এর মধ্যে হেতালের মায়ের অনুপস্থিতিতে ধর্ষণ-খুন-চুরির ঘটনা ঘটে৷ আধ ঘণ্টায় ঘটনার এ হেন ঘনঘটা, ২১টি এলোপাথাড়ি আঘাত অসম্ভব বলেই দাবি আইএসআইয়ের গবেষকেদের৷ রক্তে ভেসেছে দেহ, অথচ অস্ত্রই উদ্ধার হয়নি!
যে ঘটনাগুলো ধনঞ্জয়ের বিরুদ্ধে যায় সেগুলো হল-
  1. খুনের কাছাকাছি সময়ে ধনঞ্জয়কে হেতল পারেখদের ফ্ল্যাটের আশপাশে দেখা গিয়েছে
  2. খুনের পর সে নিরুদ্দেশ হয়েছিল
  3. এই দুই ব্যাপারে ধনঞ্জয় আদালতে সত্যি কথা বলেনি।
যে ব্যাপারগুলো হেতালের মা ও পারেখ পরিবারের বিরুদ্ধে যায়, সেগুলো একবার দেখে নেওয়া যাক-
  1. হেতল খুন হয়েছিল ফ্ল্যাটের মধ্য়ে। দুপুরের পর খুনের সম্ভাব্য সময়ে সেখানে হেতালের মা ছাড়া আর কেউ উপস্থিত ছিল বলে প্রমাণ নেই। এই যুক্তিতে হেতলের মা-কেই মূল সন্দেহভাজন বলে ধরতে হবে।
  2. ধনঞ্জয়কে অপরাধী সাব্যস্ত করা হয়েছিল, শুধুমাত্র ফ্ল্যাটের ভিতরে তার উপস্থিতির তথ্য ছিল মিথ্যা সাক্ষ্য প্রমাণের ওপর দাঁড়িয়ে।
  3. বাড়ির লোক ছাড়া কারও পক্ষে অল্প সময়ের মধ্যে ওই কাণ্ড ঘটিয়ে চোখে না-পড়ার মতো চেহারা নিয়ে বেরিয়ে যাওয়া কঠিন।
  4. হেতলের পোস্টমর্টেম আর ফরেনসিক রিপোর্ট ইঙ্গিত দেয়, মৃত্যুর আগে তার যৌন মিলনের ঘটনায় জবরদস্তি ছিল না। সেক্ষেত্রে ধর্ষণের জন্য খুনের প্রসঙ্গ ওঠে না। বরং স্বেচ্ছায় যৌন মিলনের কথা প্রকাশ হয়ে পড়ায় বাড়ির লোকের বিদ্বেষ এবং প্রতিহিংসার ইচ্ছা জন্মে থাকতে পারে।
  5. মৃতদেহ সকলের সামনে "আবিষ্কার" হওয়ার আগে ফ্ল্যাটের সদর দরজা ভাঙার জন্য হেতলের মা বড্ড তাড়াহুড়ো করেছিলেন। যেন তিনি জানতেন দরজার ওপারে জীবিত কেউ নেই। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করা আর ইন্টারকম কিংবা টেলিফোনে মেয়ের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা তিনি করেননি।
  6. মৃতদেহ দেখেই হেতলের মা একা হাতে পাঁজাকোলা করে সেই দেহ তুলে নিয়ে হাসপাতালে যাবেন বলে লিফটে ওঠেন। একতলায় পৌঁছেও তিনি লিফটের মধ্যে একঘণ্টা ঠায় বসেছিলেন কী কারণে। সদ্য যে মারা গিয়েছে তার দেহ নিয়েও এই আচরণ স্বাভাবিক নয়।
  7. হেতলের খুন 'আবিষ্কার' হওয়ার পর পুলিশ ডাকতে তিন ঘণ্টারও বেশি দেরি করে পারেখ পরিবার। তার আগে মৃতদেহ বহুবার টানাহ্যাঁচড়া আর খুনের জায়গা দিয়ে বহু লোক চলাফেরা করেছে।
  8. পুলিশ আসার পর হেতলের মাকে কিছুটা আড়াল করা হয়েছিল, যদিও খাতায় কলমে খুনের অভিযোগকারিণী তিনিই। খুনের দিন সাতেকের মধ্যে হেতালের মাকে মুম্বই পাঠিয়ে দেওয়া হয়।
  9. হেতলের মা ৪ বার অসুস্থতার অজুহাতে আদালতে সাক্ষ্য দেওয়া এড়ান। তার মধ্য়ে দুবার তিনি আদালতে হাজির থেকেও সাক্ষ্য দেননি।
  10. ধনঞ্জয়ের বাড়ি থেকে যে হাত ঘড়ি আদতে উদ্ধার হয়নি, তেমন একটা সাজানো ঘড়ি হেতালের মা লালবাজারে গিয়ে সনাক্ত করে আসেন সিরিয়াল নম্বর না মিলিয়েই। পরে পারেখরা চিঠি দিয়ে আদালতের কাছে সাড়ে তিনশো টাকার সেই ঘড়ি ফেরত চান।
  11. পুলিশ অকুস্থলে পৌঁছনোর ঘণ্টা দুয়েকের মধ্য়ে ধনঞ্জয়কে পলাতক এবং সম্ভাব্য অপরাধী বলে ঘোষণা করে দেওয়ার পিছনে পারেখ পরিবারের হাত ছিল।
  12. ধনঞ্জয় কেন খুন করে থাকতে পারে, তার একটা কারণ দাঁড় করানোর জন্য জাল নথিপত্র তৈরিতে হেতালের বাবা অংশ নিয়েছিলেন। হেতলকে ধনঞ্জয়ের উত্যক্ত করার গোটা "কাহিনী" পুলিশকে জানিয়েছিল তার বাড়ির লোক। আার কেউ এব্য়াপারে কিছুই জানত না।
  13. পারেখ পরিবারের তরফে হেতলের মায়ের বাড়ি থেকে বেরনো আর হেতলের বাবার বাড়ি ফেরার সময়ের বিকৃত তথ্য পুলিশকে দেওয়া হয়। আদালতেও সেই বিকৃতি বজায় রাখা হয়।
  14. হেতলের পেটে হজম না-হওয়া যে খাবার পাওয়া গিয়েছে, তাতে খাওয়ার পর (বা খাওয়া চলতে চলতে) মায়ের সঙ্গে সংঘাতে খুন হওয়ায় তত্ত্বের সমর্থন মেলে।
  15. হেতল খুন হওয়ার ছয় মাসের মধ্য়ে তার বাবা ৬২ বছর বয়সে, মধ্য় কলকাতার নতুন কেনা ৪ কামরার ফ্ল্যাটবাড়ি আর প্রতিষ্ঠিত ব্যবসা ছেড়ে, তাড়াহুড়ো করে সপরিবারে পাকাপাকি ভাবে মুম্বই চলে যান। তখনও হেতল মামলার সাক্ষ্য নেওয়া শুরু হয়নি। সেই সময় হেতলের দাদার পরীক্ষা সামনে ছিল। এমন কী গোপনীয়তা ছিল যে, মুম্বই যাওয়ার পরও পারেখরা আদালতে মিথ্যা বলেছেন যে, তাঁরা পদ্মপুকুরের ফ্ল্যাটেই থাকেন।
  16. পারেখ পরিবার সংবাদ মাধ্য়ম থেকে বরাবর দূরে থেকেছে। কলকাতা ও মুম্বইয়ে প্রতিবেশীদের সঙ্গে দূরত্ব বজায় রেখেছে। ধনঞ্জয়ের দোষ প্রতিষ্ঠার জন্য প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ভাবে উদ্যোগ নেওয়ার বেলায় এই উদাসীনতা দেখা যায়নি।
পরিবারের কে কাজটা করল:
  1. হেতলের বাবার জেরার সময় ধনঞ্জয়ের উকিল এক অদ্ভুত প্রশ্ন করেছিলেন। প্রশ্নটা ছিল, মৃত্যুর কয়েক মাস আগে হেতল রাধেশ্যাম নামে এক পরিচারকের পিঠে ওঠার চেষ্টা করেছিল কিনা, আর সেই নিয়ে রাধেশ্যাম ছাঁটাই হয়েছিল কিনা। হেতালের বাবা এই ঘটনা অস্বীকার করেন।
  2. পড়শিরা জানিয়েছিলেন, খুনের আগের দিন মা-মেয়ে উঁচু গলায় কথা কাটাকাটির আওয়াজ পেয়েছিলেন। যৌন মিলনের ঘটনা হেতলের বিদ্রোহের ইচ্ছা থেকেও ঘটে থাকতে পারে। বাইরে থেকেই যৌন সংসর্গ করে হেতল বাড়ি ফিরেছিলেন সম্ভবত অনেকটা দেরিতে। হেতলের মা বাড়িতে একা অপেক্ষা করছিলেন। পরিস্থিতি বিস্ফোরণের জন্য প্রস্তুত ছিল।
  3. হেতল পরীক্ষা দিতে গিয়েছিল স্কুলের ড্রেস পরে। মৃত্য়ুর সময় তার পরনে ছিল কালচে রঙের হাফ-হাতা ব্য়াগি টি-শার্ট আর গোলাপী মিডি স্কার্ট। অর্থাৎ বাড়ি ফিরে সে জামা পাল্টেছিল। সিজার লিস্ট থেকে জানা যায়, হেতলের নিম্নাংশের অন্তর্বাসে রক্তের দাগ ছাড়াও অন্য দাগ খালি চোখেই স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল। ফরেনসিক পরীক্ষায় জানা যায় নিম্নাংশের অন্তর্বাসে বীর্যও পাওয়া গিয়েছে। হেতলের ছেড়ে রাখা এই অন্তর্বাস তার মায়ের চোখে পড়ে থাকতে পারে এবং অন্তর্বাসের চিহ্ন আসলে কীসের তা অনুমান করে হেতলের মা-এর মাথায় রক্ত চড়ে যাওয়া অসম্ভব নয়।
ভুল পথে পুলিশি তদন্ত ?
হেতল পারেখের খুনের ব্যাপারে ভবানীপুর থানায় প্রথম খবর পেয়েছিল হেতলের বাবার কাছ থেকে। খবর পেয়ে যে জেনারেল ডায়েরি নথিভুক্ত করা হয়। এতে সময় লেখা হয়েছে রাত ৯.১৫। তাতে ধনঞ্জয়ের নাম উল্লেখ ছিল না। এই জেনারেল ডায়েরিকে এফআইআর বলে ধরা হয়নি। পরে পুলিশের খাতায় হেতলের মায়ের জবানবন্দি বলে চিহ্নিত নথিকে এফআইআর বলে গণ্য করা হয়।
মিথ্যা তথ্যের খতিয়ান
  1. হেতল পারেখ খুন হয়েছিল ১৪ বছর বয়সে ( আসল তথ্য: খুনের সময় হেতালের বয়স ছিল ১৮ বছর)
  2. হেতলকে খুনের পর ধর্ষণ করা হয়েছিল (আসল তথ্য: ময়নাতদন্তের রিপোর্ট অনুযায়ী হেতলের যৌন-সঙ্গম হয়েছিল মৃত্য়ুর আগে। তাকে ধর্ষণ করা হয়েছিল কিনা তা জানার জন্য অন্য কোনও তথ্য মিলিয়ে দেখা হয়নি)
  3. হেতল পারেখকে খুন করা হয়েছিল গলায় রুমালের ফাঁস দিয়ে (আসল তথ্য:পুলিশ কুকুর কোনও রহস্য ভেদ করতে পারেনি। এফআইআর-এও এই রুমাল গড়হাজির।
এত খামতি, তবু কী ভাবে মঞ্জুর হয়ে গেল মৃত্যুদণ্ড?
ঘটনার দিন থেকেই পুলিশের বড়কর্তারা প্রভাবশালী পারেখ পরিবারের বক্তব্যে সিলমোহর দেওয়া শুরু করেন৷ ধনঞ্জয়কে শূলে চড়ানোই একমাত্র লক্ষ্য হয়ে ওঠে৷ পূর্ব-নির্দিষ্ট ছক মেলানোর তাগিদই হয়ে ওঠে তদন্তের চালিকাশক্তি৷ অর্থ ও লোকবলে হীন ধনঞ্জয়ের পরিবার নিম্ন আদালতে তেমন শক্তপোক্ত আইনজীবী নিয়োগও করতে পারেননি৷ যে-সব স্বাভাবিক প্রশ্ন পাল্টা জেরায় তোলার কথা, তেমন কিছুই করা হয়নি৷ অসম লড়াইয়ে হার মানতে হয় অভিযুক্তকে৷ আপিলও এগিয়েছে নিম্ন আদালতের ছন্দেই৷ ফল যা হওয়ার তাই!
দীর্ঘ ১৪ বছরের বিচারপর্বে অনেক বিতর্ক তৈরি হয়েছে। প্রথমবার ফাঁসির নির্দেশ পিছিয়েও যায়। তবু শেষ রায় হয়— মৃত্যুদণ্ড। শোনা যায়, ফাঁসির আগে সেই সময়ের কারাকর্তার কাছে ধনঞ্জয় চট্টোপাধ্যায় একটি আর্জি করছিলেন। বলেছিলেন-
‘আপনি বড় অফিসার। দেখবেন, যে কোনও অভিযোগের তদন্ত যেন ঠিকঠাক হয়।’
জীবনের শেষক্ষণ পর্যন্ত ধনঞ্জয় নিজেকে নির্দোষ বলে দাবি করেছিলেন। কিন্তু, মানুষ তাঁর কথা বিশ্বাস করতে চায়নি। ফাঁসির দিন গ্রামের বাড়ির অন্ধকার ঘর থেকে বাইরে বের হননি ধনঞ্জয়ের বৃদ্ধ বাবা। ষাট পেরনো সেই ব্রাহ্মণ পুরোহিত ধনঞ্জয়ের ফাঁসির পর বাড়ির মন্দিরে কালীর থানে প্রার্থনা করেছিলেন যেন মৃত্যুর পর ভাল থাকে তাঁর ছেলে। তবে, তিনি বলেছিলেন একদিন এই বিশ্ব চরাচরেই প্রমাণিত হবে তাঁর ছেলে কতটা নির্দোষ ছিল। ধনঞ্জয়ের বৃদ্ধ বাবা আজ আর বেঁচে নেই। তাঁর স্ত্রী-র বর্তমান ঠিকানা ক'জন জানেন তা কেউ ঠিক করে বলতে পারেন না।
ধনঞ্জয় বারবার বলেছিলেন তিনি নির্দোষ। যদিও আদালতে যাবতীয় সাক্ষী, প্রমাণ তাঁর বিরুদ্ধেই যায়। অনেকেই আরুশি হত্যা মামলার সঙ্গে এর তুলনা করেন। অনেকেই বলেন, ধনঞ্জয় চট্টোপাধ্যায় যে মামলায় অভিযুক্ত ‘প্রমাণিত’ হয়েছেন, তার বহু কিছুই ধোয়াঁশায় ভরা, বহু ‘প্রমাণ’ মূলত গোঁজামিল। এমনকি সমস্ত সাক্ষ্যপ্রমাণ জড়ো করে এগোলে ধনঞ্জয় চট্টোপাধ্যায়ের ঘটানো ‘অপরাধ’ আদৌ প্রমাণ করা যায় কিনা, এ নিয়েই সন্দেহ তৈরি হয়। এমনকি ওই সাক্ষ্যপ্রমাণ থেকে ভিন্নতর সিদ্ধান্তে পৌঁছনোও সম্ভব ছিল বলে দাবি ওঠে।
সূত্র-
  • 'আদালত মিডিয়া সমাজ এবং ধনঞ্জয়ের ফাঁসি' (দেবাশিস সেনগুপ্ত, প্রবাল চৌধুরী, পরমেশ গোস্বামী।
বি.দ্র- লেখাটি সংগৃহীত 

No comments:

Post a Comment