Translate

Thursday, January 27, 2022

গ্রেট ব্রিটেনে ৩৬৫ দিন



 একটা সময় ছিল, আজকের লন্ডন তথা তৎকালীন বিলাতের নাম শুনলেই অজানা এক স্বপ্নপুরীর কথা মনে ভাসত। যেখানে রাজা-রাণীরা থাকে, বিশাল সৈন্যবহর কিংবা চোখধাঁধানো দালানকোঠা। সেদিন ফুরিয়েছে, এখন বিশ্বায়নের কল্যাণে  পৃথিবী ছোট হয়েছে। একটু অবস্থাসম্পন্ন হলেই বাঙালীরা এখন কক্সবাজার, রাঙামাটির মত বিদেশে ঘুরতে যায়। তাই লন্ডন-আমেরিকা আগের মতো সমীহা জাগায় না।

তারপরও উচ্চশিক্ষা গ্রহণ কিংবা বিশ্বদেখতে আগ্রহী বঙ্গসন্তানের সংখ্যা কম নয়। আমিও তাদের একজন। বিশ্ববিদ্যালয়ের গণ্ডি পেরিয়ে হঠাৎ মনে হলো বিশ্ব দেখা প্রয়োজন। যেই কথা সেই কাজ। ইংরেজি ভাষাজ্ঞান প্রমাণ করতে আইইএলটিএস দিলাম। পরবর্তী ধাপগুলো পেরিয়ে গেলাম চোখের পলকেই। ধীরে ধীরে লন্ডনে আসার দিন ঘনিয়ে আসতে লাগল। চলেও আসলাম অনেকটা হুট করেই।

তার্কিশ এয়ারলাইন্স এর বিমানে করে নিজ মাতৃভূমি ছেড়ে রওনা করলাম এক নিষ্ঠুর সন্ধ্যায়। প্রিয় মানুষদের থেকে বিদায় নিয়ে বুকে পাথর বেঁধে পার হলাম ইমিগ্রেশন। বারবার ফিরে তাকাচ্ছিলাম চিরচেনা রাজধানী ঢাকার দিকে, আমার দেশের দিকে। দীর্ঘ বিচ্ছেদের কথা ভাবতেই বুকের ভেতর হাহাকার করে  উঠল।

শুরু হল দীর্ঘ আকাশযাত্রা। প্রায় ৯ ঘন্টা বাতাসের উপর ভেসে ভেসে ঢাকা-লন্ডন ফ্লাইটের যাত্রাবিরতী তথা ট্রানজিট এর জন্য থামতে হয়েছিল তুরস্কে। সুলতান সুলেমান কিংবা মহাবীর দিরিলিস আরতুগ্রল এর স্মৃতিবিজরিত তুরস্কের ইস্তাম্বুল বিমানবন্দরে পা রাখার মধ্য দিয়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে প্রবেশ করলাম। বিশাল বিমানবন্দর, চোখ ধাঁধানো আলোকসজ্জা, অত্যাধুনিক প্রযুক্তি কিংবা আভিজাত্য, সব কিছু ছাপিয়ে বারবার মনে পড়ছিল মায়ের কথা, আমার মাতৃভূমির কথা।

প্রায় ৩ ঘন্টা যাত্রাবিরতী শেষে আবার লন্ডনের উদ্দেশ্যে যাত্রা করলাম। সেই লন্ডন, যেখানে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এসেছিলেন ১৮৭৮ সালে, মাইকেল মধুসূদন দত্ত এসেছিলেন ১৮৬২ সালে। হিথ্রো বিমানবন্দরে নেমে মনে হল সম্পূর্ণ অন্য এক জগৎ, চারদিকে অচেনা মুখের সারি। কেউবা আফ্রিকার, কেউবা ইউরোপীয় আবার কেউবা আমেরিকান। ইমিগ্রেশনের লাইনে দাঁড়িয়ে অনেকটা অসহায় হয়ে গেলাম। নিজের আত্নীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব চেনামুখগুলোকে হাজার মাইল দূরে ফেলে কোথায় এলাম। হাজার মানুষের মাঝেও যেন একা আমি, খুব একা।

ইমিগ্রেশন শেষে লন্ডনের বিখ্যাত কালো ক্যাবে চড়ে গন্তব্যের দিকে রওনা হলাম । অসম্ভব ঠান্ডা ছিল চারদিক, গরমের দেশের মানুষ হওয়ার ঠান্ডা যেন জেকে বসল শরীরে। আশেপাশে গাছের সারি, উচু-নিচু টিলা আর সবুজ মাঠ দেখতে দেখতে প্রাণ জুড়িয়ে গেল। দীর্ঘ ১ ঘন্টার যাত্রা শেষে শেতাঙ্গ ড্রাইভারের ডাকে তন্দ্রা কাটল। গাড়ি থেকে নেমে এই প্রথম ব্রিটেনের রাণীর ছবি সম্বলিত পাউন্ড দিলাম। ইংরেজদের স্বভাবসুলভ "থ্যাংক ইউ" দিয়ে বিদায় নিল সে। শুরু হল আমার নতুন জীবন, প্রবাস জীবন।

প্রথম থেকেই পড়াশোনা এবং কাজের সূত্রে ব্রিটিশদেরকে খুব কাছ থেকে দেখার সুযোগ হয়েছে। জাতি হিসেবে তারা খুবই রক্ষণশীল এবং ভদ্র। তাদের 'সেন্স অব হিউমার' কিংবা হাস্যরসের একটি অদ্ভুত অনুভূতি রয়েছে যা সাধারণত বিদেশীরা বুঝতে পারে না। প্রকৃতপক্ষে, ব্রিটিশরা খুব স্বতঃস্ফূর্ত নয়, অনেকটাই ইনট্রুভার্ট। তারা সর্বদা একটি নির্দিষ্ট দূরত্ব বজায় রাখে। খুব সতর্কতার সাথে অনুভূতি এবং আবেগ প্রকাশ করে। ব্রিটিশদের মতে, তাদের সেরা বৈশিষ্ট্যগুলি হল উন্নত সংস্কৃতি এবং বিনয়। তারা সবকিছই লাইনে দাঁড়িয়ে করতে পছন্দ করে। এদেশে প্রচুর দাতব্য সংস্থা রয়েছে, অভাবীদেরকে তারা উদার হস্তে সহযোগীতা করে। তারা খুবই নিয়মানুবর্তী আর সময়সচেতন। তাদের ৫ মিনিট, ৫ মিনিটের মতই হয়, আমাদের বাঙালীদের মত ২০ মিনিট হয়ে যায়না। তারা জন্মদিন, ক্রিসমাস, মৃত্যুদিন খুব আড়ম্বের সাথে পালন করে। বিভিন্ন কারণে তারা একজন আরেকজনকে উপহার দেয়। পরিবারের সদস্যদের সাথে তাদের সম্পর্ক খুব ফরমাল, তারা একে অন্যের ব্যক্তিগত বিষয়ে নাক গলায় না। এ বিষয়টি তাদেরকে স্বাধীনচেতা হতে সহযোগীতা করেছে।

ব্রিটিশরা বলে, "There is no place like home", নিজের বাড়িকে তারা খুব পছন্দ করে। "Sweet Home" কথাটা তারাই বলে। প্রায় ৭০ শতাংশে ব্রিটিশ মানুষের নিজস্ব বাড়ি রয়েছে। বেশিরভাগ বাড়িতেই একটি বাগান থাকে যেখানে তারা ফুল চাষ করে। গাছের যত্ন নেওয়ার জন্য অনেক সময় ব্যয় করে তারা। কুকুরের প্রতি রয়েছে তাদের অপরিসীম ভালোবাসা। সচ্ছল প্রায় প্রতিটি পরিবারে এক বা একাধিক কুকুর থাকবেই। যদিও তারা 'পরিবার সংস্কৃতি'তে উদাসীন। আমাদের কাছে যেটা 'নিষ্ঠুরতা' তাদের কাছে সেটা খুব সাধারণ ব্যাপার।

ব্রিটিশরা ব্যক্তিসাতন্ত্রবাদী। তারা আগেও ইউরোপ থেকে বহুকাল বিচ্ছিন্ন ছিল, এখনও আক্ষরিকভাবে বিচ্ছিন। চায়ের ভক্ত ব্রিটিশরা সকালের নাস্তার ব্যাপারে খুব সিরিয়াস। ব্রেড,বেকন,সসেজ, টমেটো, বিন্স থাকবেই। তারা ঘরে থাকতে খুব পছন্দ করে। তাদেরকে বলা হয়, 'A Nation of stay at homes'। ইংরেজি প্রবাদ আছে, 'একজন ইংলিশম্যানের দূর্গ হলো তার ঘর"। কথায় কথায় ধন্যবাদ দেয়া কিংবা সরি বলা তাদের বিনয়ী সংস্কৃতির অংশ। জীবনের খুব বাজে পরিস্থিতেও তারা হাসতে জানে। এই গুণটি তাদেরকে অনেক ইতিবাচক অনুপ্রেরণা দেয়।

ইংরেজরা তাদের সংস্কৃতির কারণেই এত উন্নত। তারা দু'চারশো বছর সারা পৃথিবীকে তস্করের মত লুট করেছে। এর বিনিময়ে তারা সারা বিশ্বকে অনেক কিছু শিখিয়েছে। ইংরেজদের কাছ থেকে সত্যিই শিক্ষার অনেক কিছু আছে।

এসব শিক্ষা কিছুটাও যদি আমার মাতৃভূমিতে বাস্তবায়ন করা যেত, তাহলে বাংলাদেশ আরো অনেক এগিয়ে যেত। একজন আশাবাদী মানুষ হিসেবে প্রতিমুহূর্তে ভাবি, বাংলাদেশেও একটি সভ্য সংস্কৃতি বাস্তবায়িত হবে। আমরাও সুখী দেশের তালিকায় উপরের দিকে থাকব। আমাদের টাকা-পয়সা কম থাকতে পারে, বিভিন্ন সমস্যা থাকতে পারে, কিন্তু তাই বলে আমরা অসুখী হবো কেনো।



1 comment:

  1. I always pray for you and your famil. Be nomal. Be happy. Be strong. This is your transition period. I hope your third generation will become Englishman in future by the grace of Allah. May Allah fulfill your all honest desire.

    ReplyDelete