Translate

Sunday, July 17, 2022

সিঙ্গারা তিনকোনা হওয়ার গল্প

রাজার পছন্দ ছিল গরম খাবার। রাজমহলের রান্নাশালা থেকে লুচি বানিয়ে দরবারে রাজার সামনে নিতে নিতে সবই ঠান্ডা হয়ে যেত।  বারংবার ঠান্ডা লুচি পাঠানোয় রাজবাড়ির বাবুর্চি গুণীনাথ অনুমতি চেয়েছিলেন রাজসভায় ঠান্ডা মিষ্টি পাঠাতে। রাজচিকিৎসকের পরামর্শে ডায়াবেটিসে আক্রান্ত রাজা রেগেমেগে ধানুসকে শূলে চড়ানোর হুকুম দিয়েছিলেন। অনেক অনুনয় বিনয় করে নিজের প্রাণ রক্ষা করেছেন বাবুর্চি গুণীনাথ। রাজা আদেশ দিয়েছেন -তাকে তিনরাত্রের মধ্যে দেশত্যাগ করতে।


দ্বিতীয় রাত্রে গুণীনাথেরর স্ত্রী ঠিক করেছে দেশত্যাগের আগে একবার দেখা করবে রাজার সাথে। সেইমতো তৃতীয়দিন সকাল বেলা রাজদরবারে এসে প্রণাম জানালো স্বয়ং রাজামশাইকে। রাজসভায় আসার কারণ জিজ্ঞেস করায়, রাজাকে জানালো - সে নাকি এমনভাবে লুচি তরকারি করতে পারে, যা রাজা আধঘন্টা বাদে খেলেও গরম পাবেন।

 
সন্দিহান রাজা কিঞ্চিৎ কৌতূহলী হয়ে গুণীনাথের স্ত্রীকে পাঠালেন রান্নাশালায়। জানিয়ে দিলেন যখন রাজসভা থেকে খবর যাবে তৎক্ষণাৎ খাবার পৌঁছানো চাই। বাবুর্চির স্ত্রী মৃদু হেসে মহারাজকে জানিয়েছিলো - খাদ্যদ্রব্য রাজসভায় তৎক্ষণাৎই পৌঁছবে, কিন্তু অনুগ্রহ করে তিনি যেন কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে খান - অন্যথায় মহামান্য রাজকীয় জিহ্বা পুড়ে যেতে পারে।
প্রধান বাবুর্চি (রাজ-পাচক) আলুর তরকারি তৈরি করে পাকশালে দাঁড়িয়ে কাঁপছেন, হুকুম এলেই লুচি ভাজতে হবে। ময়দা মাখা রয়েছে হাতের সামনে। বাবুর্চির স্ত্রী কাঁচা ময়দার ভেতর লুচির জন্য তৈরি সাধারণ তরকারি ভরে দিয়ে, সমভুজাকৃতি ত্রিভুজের গড়ন বানিয়ে আড়ষ্ঠ রাজ পাচকের সামনে তুলে ধরল।
রাজদরবার থেকে আদেশ আসতেই তরকারির পুর ভর্তি দশটি ত্রিভুজাকৃতির লুচি ফুটন্ত ঘি ভর্তি কড়াইতে ভেজে, নিমেষের মধ্যে সোনালী রঙের সিঙ্গারা তুলে নিয়ে স্বর্ণথালায় সাজিয়ে নিজেই নিয়ে গেল রাজসভায়।


মহারাজ এরূপ অদ্ভুত দর্শন খাদ্যবস্তু দেখে স্তম্ভিত। সেই মহিলা অত্যন্ত বিনীতভাবে জানালো - খাদ্যদ্রব্যটির নাম সমভুজা।" মহারাজ যেন সম্পূর্ণ বস্তুটি মুখে না ঢুকিয়ে একটি কামড় দিয়ে দেখেন - ঠাণ্ডা না গরম এবং অনুগ্রহ করে স্বাদটি জানান।"
মহারাজ স্বাদ জানাননি। তিনি তিনটি মুক্তো মালা খুলে বাবুর্চির স্ত্রীয়ের হাতে দিয়েছিলেন। একই সাথে রাজবাড়ির বাবুর্চি গুণীনাথের দণ্ড প্রত্যাহার করেছিলেন। প্রায় ছ'মাস পর হেসে উঠেছিলেন মহারাজ, শান্তি পেয়েছিলো তামাম প্রজাকুল।
মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র। ১৭৬৬ সালে কৃষ্ণনগরের রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের রাজসভার সেই বাবুর্চি , কলিঙ্গ তথা বর্তমান ওড়িষ্যা থেকে আগত গুণীনাথ হালুইকরের স্ত্রী ধরিত্রী দেবী আবিষ্কার করেছিলেন সিঙ্গাড়া।
শাক্ত সাধক, পরবর্তিকালে মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্রের সভাকবি রামপ্রসাদ, স্বয়ং বিকেলের কাজ সেরে প্রতিসন্ধ্যায় বসতেন একথালা সিঙ্গাড়া নিয়ে। দোলপূর্ণিমার সন্ধ্যায়, মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্রের দরবার থেকে বাইশটি সুসজ্জিত হাতি সিরাজউদ্দোলার সেনাপতি উমিচাঁদের কাছে বাইশটি স্বর্ণথালা ভর্তি বাইশশোটি সিঙ্গাড়া পৌঁছে দিয়েছিল। ভারতীয় খাদ্য হিসেবে সিঙ্গাড়ার সাথে রবার্ট ক্লাইভের প্রথম সাক্ষাৎ হয়, এই মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্রেরই সৌজন্যে। সিঙ্গাড়ার জন্য ইতিহাস স্বীকৃতি দিয়েছে মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্রকে। নাম ভুলে গেছে সেই বাবুর্চির স্ত্রী ধরিত্রীর কথা।


ইংরেজিতে বলে, Comoon sense makes people uncommon। ধরিত্রীদেবী সাধারণ বুদ্ধি খাটিয়ে আবিষ্কার করেছিলেন এই অসাধারণ খাদ্যদ্রব্যটির, যেটি সেই ১৭৬৬ সাল থেকে ছড়িয়ে পড়েছে বাংলা তথা সারা ভারতে। ঐতিহাসিকদের মতে, এর বহু আগে, নবম শতাব্দীতে পারস্যের অধিবাসীরা যব এবং ময়দার তালের সঙ্গে গাজর কড়াইশুঁটি রসুন ও মাংস মেখে সেঁকে খেতো, যাকে বর্তমান সিঙ্গাড়ার জনক হিসাবে ধরা হলেও, সুদূর পারস্য থেকে ভারতবর্ষে এসেও তাঁরা ময়দার তালে মাংসের কুঁচি ঢুকিয়ে সেঁকেই খেতেন। এরও বহুপরে তাঁরা ভারতবর্ষের উত্তরপূর্ব উপকূলে বিভিন্ন মশলা সহযোগে তৈরি আলুর তরকারি, ময়দার ভেতর ঢুকিয়ে ঘিয়ে ভাজার পদ্ধতিতে চমৎকৃত হ'ন।


ডায়বেটিক পেশেন্টদের ঘন ঘন খিদে পায়। চিকিৎসাবিজ্ঞান উন্নত হয়েছে। ডাক্তাররা বলছেন, অনেকক্ষণ অন্তর একসাথে প্রচুর পরিমানে না খেয়ে, ক্যালোরি মেপে কিছুক্ষণ অন্তর অল্পসল্প খাবার খেতে। কিন্তু সেযুগে ডাক্তারবাবুদের হৃদয় ছিলো বিশাল। রোগীরা তখন তেল ঘি মশলা, ভাজা খেলেও তাঁরা রাগ করতেন না। নিশ্চিতভাবেই আজকের যুগে ডাক্তার বাবুরা আঁতকে উঠবেন যদি দেখেন কোনো ডায়াবেটিক পেশেন্ট প্রতিঘন্টায় সিঙ্গাড়া ওড়াচ্ছেন, তবু, আঁটকানো যায়নি সিঙ্গাড়াকে। শহুরে অভিজাত পরিবারের বৈঠকখানায় মোটা গদির সোফায় বসা অতিথির থালাই হোক বা প্রত্যন্ত গ্রামের জরাজীর্ণ চায়ের দোকানের সামনে নড়বড়ে বাঁশের বেঞ্চে রাখা তেলচিটে কালো ভাঙ্গা বেতের চুবড়ি - বিকেল সাড়ে চারটেই হোক বা সকাল পৌনে দশটা, মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্রের রান্নাশালার উদ্ভাবনটি সর্বত্র সর্বদা সর্বগামী।

যা রাজসভায় রাজ-সম্মুখে পরিবেশিত হয়, তার কৌলীন্য প্রশ্নাতীত হবে - এই তো স্বাভাবিক।

ভাষাবিদদের মতে, সমভুজা--> সম্ভোজা--> সাম্ভোসা--> সামোসা।মতান্তরে, সমভুজা--> সম্ভোজা--> সিভুসা--> সিঁঙুরা(নদীয়ার কথ্যভাষার প্রভাবে)--> সিঙ্গাড়া।

সময় দিয়ে পড়ার জন্য অনেক ধন্যবাদ ।
তথ্য সূত্র : ইতিহাসের বিভিন্ন তথ্য

No comments:

Post a Comment